• ঢাকা
  • শুক্রবার , ১৬ মে ২০২৫ , রাত ১১:২৫
  • ২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
ব্রেকিং নিউজ
হোম / রাজনীতি

আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু শাহবাগ

রিপোর্টার : amarsonardesh.com
আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু শাহবাগ ই-পেপার/প্রিন্ট ভিউ

আমার সোনার দেশ ডিজিটাল : শুরুটা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে। এতে উত্তাল হয়ে উঠে রাজধানীর শাহবাগ। হয়ে উঠে আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু। গণজাগরণ মঞ্চ দিয়ে দেশ কাঁপানো এই আন্দোলন থেকে ফলও পেয়েছেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের দাবির প্রেক্ষিতে সে সময় আইনও পরিবর্তন করা হয়।  নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে উচ্চ আদালতে দেয়া হয় ফাঁসির রায়। সেই আন্দোলনের কথা এখনো মানুষের মুখে মুখে। সেই আন্দোলনের কুশীলবরা কিছুদিন পরই হরিয়ে যেতে থাকেন। এখন একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে। এরপর  ফের আলোচনায় আসে কোটা সংস্কার আন্দোলনে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পুরো সময় ছিল শাহবাগ সরগরম। প্রতিদিন মিছিল মিটিং, পুলিশের ব্যারিকেড, জলকামান শাহবাগকে রূপ দেয় আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে। এই শাহবাগেই ছাত্রলীগ হামলে পড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর। শাহবাগের আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমজনতাও। গোটা বাংলাদেশ হয়ে উঠে অগ্নিগর্ভ। এখান থেকেই স্লোগন উঠে তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার। কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার। আন্দোলনের উত্তাপ গিয়ে পড়ে গণভবনে। আর উত্তাপ সহতে না পেরে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালান। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে কোটাবিরোধী আন্দোলন দুটিতেই চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে জনগণকে। বিশেষ করে শাহবাগকে ঘিরে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তিনটি হাসপাতাল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিদিন সারা দেশ থেকে এই তিন হাসপাতালে আসেন শত শত রোগী। এসব রোগীকে হাসপাতালে যেতে বেগ পেতে হয়েছে অনেক। আবার কেউ কেউ হাসপাতালে যেতে না পেরে অন্য কোনো হাসপাতালে যেতে হয়েছে। কেউ বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এম্বুলেন্সেই মারা গেছেন। এই দুটি সফল আন্দোলনের পর শাহবাগ হয়ে উঠে দেশের আন্দোলনের রাজধানী। পাঁচই আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলে শাহবাগ হয়ে উঠে যেন আন্দোলনের তীর্থস্থান। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ এসে বিভিন্ন দাবি নিয়ে শাহবাগে বসে পড়ছেন কোনো দপ্তর, কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। এতে করে  শাহবাগ এর আশপাশের সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। শাহবাগ দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর রেশ গিয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকার অন্য সড়কে। এতে গোটা রাজধানীই হয়ে উঠে যানজটে কাবু। এতে ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রী সাধারণকে। ছাড়া শাহবাগের আশপাশে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। শাহবাগের আশপাশে রয়েছে রাজধানীর অন্যতম বেশকটি মার্কেট। ওইসব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা আন্দোলন এলেই দোকান বন্ধ করে দিতে হয়। কারণ কাস্টমার আসবে না। তাছাড়া নিজেদের নিরাপত্তার কথাও চিন্তা করে তারা। অন্তর্বর্তী সরকারে পাঁচ মাসে প্রায় দিনই শাহবাগ ছিল অবরুদ্ধ। রিকশাচালক থেকে শুরু করে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আনসার বাহিনী, সর্বশেষ বিডিআর বিদ্রোহে চাকরিচ্যুত পরিবারের সদস্যরা তাদের দাবি নিয়ে হাজির হন শাহবাগে। যেন শাহবাগে গেলেই সবার দাবি আদায় হবে- এমনটা ধারণা অনেকের। দেশ স্বাধীনের পর যত আন্দোলন হতো তার জন্য নির্ধারিত ছিল পল্টন ময়দান। এরপর একসময় বড় দলগুলোর অফিসের সামনেও সমাবেশ হতো। এরপর ফের পল্টন ময়দান উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। সেখানেই হতে থাকে সভা সমাবেশ, আন্দোলন সংগ্রাম। একসময় পুরানা পল্টন ক্রীড়া পরিষদ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেলে সভা-সমাবেশ আন্দোলনের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় মুক্তাঙ্গনকে। বেশ কয়েক বছর মুক্তাঙ্গনে সভা-সমাবেশ হয়েছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে মুক্তাঙ্গন থেকে এই সভা সমাবেশ নেয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। যা এখনো বলবৎ আছে। যদিও মাঝখানে জাতীয় সংসদের সামনের রাস্তাকে সমাবেশের জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল। দুয়েকটি সমাবেশ সেখানে হয়েছিলও।  কিন্তু শেষপর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই টিকে রয়েছে সভা-সমাবেশের জন্য। রাজনৈতিক দলগুলো যদিও রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ছোটখাট প্রোগাম করে। আবার কেউ প্রেস ক্লাবের সামনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়। মাঝখানে কিছু দিন হাইকোর্টের সামনে দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু গত প্রায় পনেরো বছর বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলোকে বেশির ভাগ সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়নি। কোনো কোনোটির অনুমতি দেয়া হলেও সকালে প্রোগ্রাম আগের রাতে অনুমতি দেয়া হয়েছে নানা শর্তসাপেক্ষে। তখনই প্রশ্ন উঠেছে গণজাগরণ মঞ্চ দিনের পর দিন শাহবাগকে অবরুদ্ধ করে আন্দোলন করলেও সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেয়া হয়নি। কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ যেভাবে হামলা করেছে, পুলিশ যেভাবে গণপিটুনি দিয়েছে, গুলি করেছে তা ছিল দেশের ইতিহাসে এক রেকর্ড। রাজধানীর শাহবাগকে এখন বঞ্চিত দাবি করা সকলেই আন্দোলনের রাজধানী হিসেবে গণ্য করছে।  শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওপর হামলার অভিযোগ এনে ১২ আগস্ট শাহবাগ মোড় অবরোধ করে হিন্দু সম্প্রদায়। দ্রুত বিচারের দাবি জানায় তারা। একই প্রেক্ষাপটে ১৩ সেপ্টেম্বর দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ দোষী ব্যক্তিদের বিচারসহদফা দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করা হয়। হিন্দু সমপ্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত সনাতনী অধিকার আন্দোলনের ব্যানারে এই কর্মসূচি পালিত হয়। ১৪ আগস্ট চার দফা দাবিতে সপ্তাহব্যাপীরেজিস্ট্যান্স উইককর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর অংশ হিসেবে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি এবং শহীদদের স্মরণে শাহবাগ থেকে পদযাত্রা, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন দোয়ার কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। সেপ্টেম্বর শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে মহাসমাবেশ করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। এরপর দুপুরটার দিকে তারা শাহবাগ মোড়ে সড়ক অবরোধ করেন। অবরোধ থেকে তারা জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা প্রতিনিধিদল এসে দাবি পূরণে সুস্পষ্ট আশ্বাস না দেয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। বেশকিছু দিন তারা এই আন্দোলন চালিয়ে যান। পরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩২ বছর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভাতা বৃদ্ধি করে ৫০ হাজার টাকা করার দাবিতে ২২শে ডিসেম্বর থেকে শাহবাগে কর্মবিরতি অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত পোস্টগ্রাজুয়েট বেসরকারি প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকরা। প্রথম পাঁচ হাজার টাকা ভাতা বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার। তবে ট্রেইনি চিকিৎসকরা এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পরে সরকারের পক্ষ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বর্ধিত ভাতার প্রজ্ঞাপন মেনে নিয়ে গত ৩০শে ডিসেম্বর আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন চিকিৎসকরা।  সম্প্রতি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় নিরপরাধ সদস্যদের মুক্তি এবং চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের পুনর্বহালের দাবিতে জানুয়ারি সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে যমুনায় পদযাত্রা শুরু করে পরিবারের সদস্যরা। তারা শাহবাগ পর্যন্ত গেলে সেখানে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এরপর তাদের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাত পেতে যমুনায় যায়। একই দাবিতে দুইদিন ধরে শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করলেও দাবি আদায়ে পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবারশাহবাগ ব্লকেডকর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনরত বিডিআর তাদের পরিবারের সদস্যরা। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি কাদের মোল্লার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায় ঘোষণা করে আদালত। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় তাকে। রায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনলাইন এক্টিভিস্টদের একটি গ্রুপ এই আন্দোলনের সূচনা করে। পরে বিভিন্ন সংগঠন সংহতি প্রকাশ করে এই আন্দোলনে। গড়ে উঠে গণজাগরণ মঞ্চ। আন্দোলনের মুখে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আইন সংশোধনের ঘোষণা করে এবং পরে সেটি কার্যকর হয়। আইন সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার ব্যবস্থা রাখে। বিতর্ক থাকলেও এই আইনের ফলে কাদের মোল্লাসহ আরও কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর হয়। তবে মে মাসে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরে কর্মসূচির ফলে শাহবাগ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। ২০১৮ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে দ্বিতীয় কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। কোটা সংস্কারেরদফা দাবি সরকার না মানায় শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘরের সামনেঠা মার্চ অবস্থান কর্মসূচি পালন করে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ১৪ মার্চ লাঠিপেটা করে পুলিশ। এতে অন্তত ১৫ জন আহত হন। চাকরিপ্রত্যাশী ৫০ জনকে আটক করা হয়। প্রতিবাদে সেদিনই শাহবাগ মোড় অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। নানা কর্মসূচির ডাক দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ হাইকোর্ট বাতিলকৃত কোটা পুনরায় বহাল করে। ফলে পুনরায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথমদিকেদফা বাংলা ব্লকেডকর্মসূচির ঘোষণা আসে এই রাজধানীর এই শাহবাগ থেকেই। যার পরিণতি সরকার পতনের একদফায় গিয়ে ঠেকে। আগস্ট প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সফলতার পর শাহবাগ হয়ে উঠে আন্দোলনকারীদের রাজধানী।  


Bangladesh

আরও পড়ুন