আমার সোনার দেশ ডিজিটাল : আওয়ামী লীগ সরকারের পতন-পরবর্তী কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনে ভারতের পর্যটন ও চিকিৎসা ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নেমেছে। পর্যটন ও চিকিৎসার মাধ্যমে ভারতের ডলার আয়ের অন্যতম উৎস বাংলাদেশ। দিন যত গড়াচ্ছে দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস ততই বাড়ছে। সবশেষ আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও পতাকা পোড়ানোর ঘটনা এবং কিছু ভারতীয় নেতার বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বড় অংকের ডিসকাউন্ট দিয়েও কলকাতার হোটেলে বোর্ডার মিলছে না। কলকাতার নিউমার্কেটকেন্দ্রিক দোকানপাটও বাংলাদেশি ক্রেতাশূন্য। মানি এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার ভিসা-সংক্রান্ত জটিলতায় হাসপাতালগুলোও বাংলাদেশি রোগী পাচ্ছে না। এ অবস্থায় বুধবার মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রা রুপির মান সর্বকালের তলানিতে পৌঁছেছে। ডলারের বিপরীতে রুপির দর এই প্রথম ৮৪ দশমিক ৭৫-এ নেমে এসেছে। বাংলাদেশের এওট্রেক ট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুরুল আলম নয়ন বলেন, দেশের মোট ট্যুরিজমের অর্ধেক কয়েক মাসে কমে গেছে। ভারতে আগে যেখানে প্রতিদিন গড়ে সাতটি ফ্লাইট যেত, সেখানে এখন সপ্তাহে দুটি ফ্লাইট যাচ্ছে। ভারতে চিকিৎসা ও বেড়াতে যাওয়া মানুষের একটি অংশ এখন থাইল্যান্ডে যাচ্ছে। তবে সেই সংখ্যা ৩০ শতাংশও হবে না। দেশীয় ট্যুরিজমের বিষয়ে মঞ্জুরুল আলম বলেন, সেন্টমার্টিন ও পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটকরা সহজে যেতে পারছে না। পার্বত্য অঞ্চলে গোলাগুলিতে সম্প্রতি পর্যটক যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। মানুষ দেশের বাইরে ঘুরতে যেতে না পারলে দেশেই ঘুরতে চায়। বাংলাদেশ সেই সুযোগ নিতেও ব্যর্থ হচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে আসা একাধিক বাংলাদেশি জানিয়েছেন, ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে কলকাতার নিউমার্কেটসহ আশপাশের দোকানপাটে বাংলাদেশিদের ভিড় লেগেই থাকত। ঘুরতে যাওয়া থেকে শুরু করে বিয়ের কেনাকাটাতে সামর্থ্যবানরা কলকাতাকে বেছে নিতেন। কিন্তু চলতি সপ্তাহে কলকাতার মার্কেটে বাংলাদেশি ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়নি। হোটেলগুলোতে বোর্ডার কম। বলা যায়, বাংলাদেশকেন্দ্রিক ভারতের চিকিৎসা ও পর্যটন শিল্পে বড় ধরণের ধস নেমেছে। কলকাতার বিভিন্ন হোটেলের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ডিসকাউন্টের ধুম পড়েছে। এই পর্যটন মৌসুমে যেখানে হোটেলের একটি রুম জোগাড়ে ঘাম ঝরে যেত, সেখানে হোটেলগুলো বিপুল ডিসকাউন্টের অফার দিচ্ছে। গতকাল কলকাতার অভিজাত হোটেল হোটেল ও’পার্কে ৭৫ শতাংশ ডিসকাউন্টের ঘোষণা দেওয়া হয়। অধিকাংশ হোটেলেই ৩০-৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট ঘোষণা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয়রা নিজ দেশে উল্লেখযোগ্য অংকের রেমিট্যান্স পাঠান। বাংলাদেশি পর্যটক এবং রোগী ভারতে গিয়ে বড় অংকের ডলার খরচ করে। ভারতীয় ঠিকাদারি এবং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা রয়েছে বাংলাদেশে। প্রতি বছর বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশ থেকে বছরে ২০ বিলিয়ন ডলারের বেশি যায় ভারতে। বিপরীতে ভারত থেকে আসে ২ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি অর্থ। ফলে ভারতীয় অনেক গণমাধ্যম বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের যে অতিরঞ্জিত তথ্য এবং ভুয়া খবরে উত্তেজনা তৈরির পরিকল্পিত চেষ্টা করছে, এতে ভারতেরই ক্ষতি বেশি হচ্ছে। এদিকে, এ অবস্থাতে ত্রিপুরার হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশিদের ভাড়া না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালও বাংলাদেশি রোগী না দেখার ঘোষণা দিয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রচার পেতে বাংলাদেশিদের বয়কটের ডাক দিচ্ছেন কিছু ব্যবসায়ী। তাতে উত্তেজনা বাড়ছে। আদতে এসব অঞ্চল ও হাসপাতালে বাংলাদেশের আনাগোনা কম। আর কলকাতার নিউমার্কেট বাংলাদেশি ক্রেতার ওপর নির্ভরশীল। কলকাতার ব্যবসায়ীরা জেনে বুঝে বয়কটের ডাকে শামিল হননি। জানা গেছে, কলকাতার নিউমার্কেট এলাকার কয়েকশ’ হোটেল, শতাধিক মানি এক্সচেঞ্জার, রেস্তোরাঁ ও পরিবহন ব্যবসা বাংলাদেশিদের ওপর নির্ভরশীল। এসব ব্যবসা সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার পরিবারের জীবিকা নির্ভর করছে বাংলাদেশিদের মাধ্যমে। দুই দেশের সম্পর্কের টানাপড়েনে তারাই বেশি চাপে পড়েছেন। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, গত ৫ আগস্টের পর আমদানি কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। রপ্তানি কমেছে প্রায় ২৮ শতাংশ। সম্পর্কের অবনতিতে তাই ভারতেরই ক্ষতি বেশি। অনিশ্চয়তা থাকায় এ বছর ভারতের বদলে মিশর ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। গত মাসেই পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়েছে পোশাক খাতের কাঁচামাল ও রাসায়নিক। সূত্র বলেছে, প্রতি বছর গড়ে ৮ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়। এর বড় অংশই যায় ভারতে। বিদেশে চিকিৎসা নিতে বছরে খরচ হচ্ছে ৪ বিলিয়ন ডলার, যার অন্তত ২ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ভারতে গিয়ে। প্রোপাগান্ডায় সায় দিয়ে বয়কট কিংবা চাপে ভারতই আয়বঞ্চিত হবে বেশি।