আমার সোনার দেশ ডিজিটাল:বিদেশি অস্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে কমাচ্ছে ভারতীয় ফৌজ। পাশাপাশি, ঘরোয়া প্রযুক্তিতে তৈরি অত্যাধুনিক হাতিয়ার রফতানিতে জোর দিয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। অস্ত্র ব্যবসায় প্রতিযোগীর সংখ্যা অনেক। আর তাই এই বাজারে পা জমাতে বিশেষ একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। তাতে সাফল্য পেলে দেশীয় প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলি যে ফুলেফেঁপে উঠবে, তা বলাই বাহুল্য বলে কলকাতার আনন্দবাজার এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করেছে।
প্রকাশিত খবরে বলা হয়,গত তিন বছরে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চলায় বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম হাতিয়ার আমদানিকারী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে ইউক্রেন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। হাতিয়ার উৎপাদনে আত্মনির্ভরতার মাধ্যমে এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার মরিয়া চেষ্টা করছে নয়াদিল্লি। এই পরিস্থিতিতে হাতিয়ার রফতানি বৃদ্ধির চেষ্টাকে মাস্টারস্ট্রোক বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ।
সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অস্ত্র ব্যবসা বাড়াতে সুনির্দিষ্ট কিছু দেশকে চিহ্নিত করে এগোনোর ছক কষেছে মোদী সরকার। সেই তালিকায় আছে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া অথচ হাতিয়ারের ব্যাপক চাহিদা থাকা একাধিক রাষ্ট্রের নাম। তাদের সঙ্গে দ্রুত প্রতিরক্ষা চুক্তি সেরে ফেলতে কূটনীতিকদের ময়দানে নামিয়েছে সরকার। অন্তত ২০টি দেশে পাঠানো হয়েছে তাঁদের।
সূত্রের খবর, পরিকল্পনামাফিক অস্ত্রের বাজার ধরতে রফতানি-আমদানি ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকে সস্তা সুদে ঋণ দেবে নয়াদিল্লি। শর্ত একটাই, সেই অর্থে কেবলমাত্র ভারতের থেকে অস্ত্র কিনতে হবে তাদের। এতে এক দিকে যেমন প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণকারী সংস্থাগুলি ক্রমাগত অস্ত্রের বরাত পেতে থাকবে, অন্য দিকে তেমন ঋণের সুদ থেকে মোটা অর্থ রোজগার করবে কেন্দ্র।
এই লক্ষ্যেই ব্রাজ়িল এবং আর্জেন্টিনা-সহ একাধিক দেশে কূটনীতিকদের পাঠিয়েছে মোদী সরকার। সূত্রের খবর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এবং আফ্রিকায় রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির ইচ্ছা রয়েছে ভারতের। ইতিমধ্যেই ফিলিপিন্সকে এই মারণাস্ত্র বিক্রি করেছে নয়াদিল্লি।
চিনের সঙ্গে সীমান্ত বিবাদের কারণে ইন্দোনেশিয়া এবং ভিয়েতনাম ভারতের থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ব্যাপারে আলোচনা চালাচ্ছে। এই তালিকায় রয়েছে ব্রাজ়িল এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির নামও। প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিওর তৈরি ৪৫ কিলোমিটার পাল্লার আকাশ প্রকৃতপক্ষে একটি ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র। ইতিমধ্যেই আর্মেনিয়াকে এটি সরবরাহ করেছে নয়াদিল্লি।
এ ছাড়া নাইজ়েরিয়া, আর্জেন্টিনা, ফিলিপিন্স এবং অস্ট্রেলিয়া সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি তেজস যুদ্ধবিমান কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। ইউরোপের কিছু দেশ ৫৫ মিলিমিটারের কামানের গোলা ভারতের থেকে সংগ্রহ করতে চায়। ইউক্রেনের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট গোলা ইতিমধ্যেই রাশিয়াকে সরবরাহ করেছে নয়াদিল্লি। পূর্ব ইউরোপের বেশ কিছু রণাঙ্গনে সেগুলি ব্যবহার হয়েছে বলে দাবি কিভের।
পাশাপাশি, প্রলয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে নয়াদিল্লির সঙ্গে চূড়ান্ত পর্যায়ে আলোচনা চালাচ্ছে আর্মেনিয়া। বর্তমানে ২৯০ কিলোমিটার পাল্লার ৩৫০ থেকে ৭০০ এবং ৫০০ থেকে হাজার কেজির উচ্চ শক্তির বিস্ফোরক বহনে সক্ষম হাতিয়ারটিকে নিয়ে চলছে দরাদরি। সব কিছু ঠিক থাকলে কাস্পিয়ান সাগরের কোলের দেশটিকেই প্রথম এই ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করবে মোদী সরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তার কথায়, ‘‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের সামনে অস্ত্র ব্যবসার দরজা একেবারে হাট করে খুলে দিয়েছে। লড়াই শুরু হওয়ার আগে বিশ্বের বহু দেশে হাতিয়ার সরবরাহ করত মস্কো। সংঘর্ষের কারণে অস্ত্রের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছে ক্রেমলিন। কিন্তু, সেটা নিজেদের ফৌজকে সরবরাহ করতে হচ্ছে তাঁদের। ফলে হাতিয়ার রফতানি কিছু ক্ষেত্রে বন্ধ রেখেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।’’
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওই আধিকারিক জানিয়েছেন, এই সুযোগ কাজ লাগাতে চাইছে কেন্দ্র। রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, ‘‘রুশ অস্ত্রের সরবরাহ পর্যাপ্ত না হওয়ায় বিশ্বের বহু দেশ বিকল্প খুঁজছে। বেছে বেছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছি আমরা।’’ পাশাপাশি মস্কোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে অত্যাধুনিক হাতিয়ার নির্মাণেও নয়াদিল্লি জোর দিচ্ছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি।
এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ব্রহ্মস সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের কথা বলা যেতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই মারণাস্ত্রটির যথেষ্ট কদর রয়েছে বিশ্বের অস্ত্র বাজারে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে মস্কোর সরকারি হাতিয়ার রফতানিকারী সংস্থা ‘রোসোবোরোনেক্সপোর্ট’-এর। একটি বিবৃতিতে তাঁরা বলেছেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। তাই যৌথ ভাবে আরও সমরাস্ত্র তৈরি করা যায় কি না, তা নিয়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে আলোচনা চলছে।’’
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে দেশীয় সংস্থাগুলির মাধ্যমে ১,৪৮০ কোটি ডলারের অস্ত্র উৎপাদন করে ভারত। ২০১৯-’২০ অর্থবর্ষের তুলনায় এর পরিমাণ ছিল ৬২ শতাংশ বেশি। ২০২৯ সালের মধ্যে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে মোদী সরকার। সে ক্ষেত্রে ৬০০ কোটি ডলারে পৌঁছোবে নয়াদিল্লির অস্ত্র ব্যবসা।
গত আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) ৩৫০ কোটি ডলারের হাতিয়ার রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল দিল্লি। কিন্তু তার এক তৃতীয়াংশ পূরণ করতে ব্যর্থ হয় সরকার। এক দশক আগে ভারতের অস্ত্র রফতানির পরিমাণ ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। সেই সূচক অনেকটাই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। বিশ্লেষকদের দাবি, দুনিয়া জুড়ে অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায়, নয়াদিল্লির সামনে রফতানি বাড়ানোর সোনালি সুযোগ রয়েছে। ভারতীয় অস্ত্র তুলনামূলক ভাবে সস্তা হওয়ায় এগুলির চাহিদা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যেমন দেশীয় সংস্থার তৈরি ১৫৫ মিলিমিটারের কামানের গোলার দাম ৩০০ থেকে ৪০০ ডলার। সেই গোলাই ইউরোপীয় দেশগুলি তিন হাজার ডলারের বেশি দামে বিক্রি করে থাকে।